আল্লামা মাহমূদুল হাসান

( সভাপতি এর বাণী )

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবের পূর্বে বিশ্বমানবতার অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। মহান স্রষ্টা আল্লাহর পরিবর্তে মানুষ নিজের হাতে গড়া মূর্তির পূজা করত, মৃত পশু ভক্ষণ করত, অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা তাদের ভূষণে পরিণত হয়েছিল। ছিনতাই-রাহাজানি ও খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি ছিল তাদের নৈমিত্তিক ব্যাপার। এভাবে তারা মনুষ্যত্বের সকল গুণ হারিয়ে পশুত্বের শেষ সীমায় উপনীত হয়েছিল। এই নাজুক পরিস্থিতিতে আল্লাহ পাক এ জগতের জন্য রহমত করে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। তিনি এ পৃথিবীতে এসে আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষার মাধ্যমে মাত্র ২৩ বছরে এমন একটি উন্নত নৈতিক গুণসম্পন্ন আদর্শ জাতি গড়ে তোলেন যারা সৃষ্টি করেছেন মানবেতিহাসের সর্বাপেক্ষা সোনালী যুগ।


পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বর জাতি যে শিক্ষার স্পর্শে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিল সেই কোরআনী শিক্ষাই মানুষ গড়ার মৌলিক শিক্ষা। মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে হেরা গুহায় এ শিক্ষাধারার সূচনা হয় এবং সুদীর্ঘ ২৩ বছর সময়কালে তা পূর্ণতা লাভ করে। বিশ্বনবী অনাগত বিশ্বের সকল মানুষের কাছে এই শিক্ষা পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রথমে পবিত্র মক্কার দারে আরকামে, অত:পর মসজিদে নববীতে মাদরাসা চালু করেন। পরবর্তীকালে সাহাবায়ে কেরাম থেকে আরম্ভ করে যুগে যুগে মনীষীবৃন্দ তা লালন করে আমাদের নিকট পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন। এভাবে এ শিক্ষাধারার বর্তমান ধারক হচ্ছে বর্তমান যুগের কওমী মাদরাসা।


যেহেতু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতিকে কোরআনভিত্তিক শিক্ষা দিয়ে সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তুলেছেন, সেহেতু এ শিক্ষার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবজাতির ইহ ও পরকালীন কল্যাণ। যেহেতু মুসলিম জাতির জন্য এ শিক্ষার কোন বিকল্প নেই, তাই এ শিক্ষাধারা সংরক্ষণ ও লালন করা মুসলিম জাতির অপরিহার্য কর্তব্য।


জ্ঞানী মহলের কাছে অবিদিত নয়, সপ্তম শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এ শিক্ষাধারা সারা পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বৃটিশ রাজশক্তির দ্বারা বিভিন্ন মুসলিম দেশে এ শিক্ষার উপর চরম আঘাত নেমে আসে। এরই অংশ হিসেবে বৃটিশ সরকার ভারত উপমহাদেশে লাখ লাখ মাদরাসা বন্ধ করে দেয়। তখন মুখলিস ওলামায়ে হক্ব বেসরকারিভাবে এ শিক্ষাধারা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন এবং উত্তর ভারতের দেওবন্দ নামক এলাকায় একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে হাজার বছর ধরে চলে আসা এই শিক্ষাধারা সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। সম্পূর্ণ বেসরকারি পর্যায়ে শুধুমাত্র জনগণের সার্বিক সহায়তায় এ ধারা চালু করা হয়েছে বিধায় বর্তমানে তা “কওমী মাদরাসা” বা “জাতীয় মাদরাসা” নামে পরিচিত।


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রবর্তিত শিক্ষাধারা যেহেতু মানবজাতির বিশেষভাবে মুসলিম জাতির ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির মাধ্যম সেহেতু এটাই মুসলিম জাতির জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা, আমাদের ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা, আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক শিক্ষার সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা। যার বর্তমান উত্তরসূরি হচ্ছে এ যুগের কওমী মাদরাসা। তাই, আমাদের পূর্ববর্তী মুখলিস আকাবির ও মনীষীবৃন্দ কওমী মাদরাসাসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে সম্মিলিতভাবে তার চিন্তাধারার সংরক্ষণ, বিকাশ, উন্নয়ন, প্রচার-প্রসার, চর্চা-গবেষণা ও অনুশীলন প্রভৃতি উদ্দেশ্য সামনে রেখে এবং দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুকরণ ও অনুসরণে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড) প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ পাক তাদের উত্তম বিনিময় দান করুন। বস্তুত, বেফাক আমাদের নিকট মুরুব্বীয়ানে কেরামের রেখে যাওয়া একটি পবিত্র আমানত।


বাংলাদেশের প্রাচীন ও সুবৃহৎ মাদরাসা আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী চট্টগ্রামসহ দেশের ৮০% কওমী মাদরাসা ইতোমধ্যে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এ যোগদান করেছে। আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান এদারায়ে তালীম বি-বাড়িয়া, হাইআতুল মাদারিসিল আরাবিয়াহ তালীমি বোর্ড মাদানীনগর নারায়ণগঞ্জ, দ্বীনী শিক্ষা বোর্ড হবিগঞ্জ, বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ড চরমোনাই বরিশাল, ইত্তেহাদুল মাদারিসিল ক্বওমিয়া ভোলা, মহিলা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ইলহাকুল মাদারিসিল ক্বওমিয়া বাংলাদেশ যাত্রাবাড়ী ঢাকা, বেফাকে যোগদান করেছে। এপর্যায়ে তাই বলা যায়, বাংলাদেশের অধিকাংশ কওমী মাদরাসা আজ বেফাকের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ।


কওমী মাদরাসা ও কওমী ওলামায়ে কেরামকে ধরাপৃষ্ঠ হতে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ইসলাম বিরোধী শক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে একের পর এক হামলা চালিয়ে আসছে। এ হামলার মোকাবেলা করতে আমাদের সদা সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আর এই ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালানোর জন্য বেফাককেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।


এপর্যন্ত বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে। এর পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মারকাযী পরীক্ষার প্রভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়ায় অধিক মনোযোগী হয়েছে। লেখাপড়ার মান উন্নত হয়েছে। সেই সাথে শিক্ষকগণও শিক্ষাদীক্ষায় আগের তুলনায় অনেক বেশি তৎপর হয়েছেন। তালিম ও তারবিয়াতের মান উন্নত হয়েছে। পরিশেষে আমি আঞ্চলিক এদারা ও ছোট-বড় সকল কওমী মাদরাসা যেগুলো এখনও বেফাকে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, সেগুলোর মুহতামিম ও পরিচালকবৃন্দের খেদমতে বেফাকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।