বেফাক সম্পর্কে


বেফাক শব্দের অর্থ হচ্ছে পারস্পরিক ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করা। পারিভাষিক অর্থে ঐক্য, ঐক্যজোট প্রভৃতি। এ হিসেবে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশের আরবী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা কওমী মাদরাসাসমূহের ঐক্যমতের সংস্থা।


যেহেতু কোরআনে পাকে ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে শক্ত করে আঁকড়ে ধর এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না”। আরো বলা হয়েছে- মুমিনগণ ভাই ভাই।


অতএব, মুসলিম জাতির মধ্যকার ভ্রাতৃত্বের বন্ধন রক্ষা করা এবং বিচ্ছিন্ন না হয়ে বরং ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহ পাকের রজ্জুকে আঁকড়ে থাকার এ নির্দেশগুলো ইসলামের বিরাট গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও মহান আদর্শ । বর্তমানে ইলহাদ ও নাস্তিক্যবাদের সয়লাবের মুখে ভ্রাতৃত্বের সুসম্পর্ক ও ঐক্যের অভাবে মুসলিম সমাজ শতধা বিভক্ত এবং বিভ্রান্তির বেড়াজালে নিপতিত। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, ইলমে ওহীর ধারক বাহক আলেম সমাজও আজ বিভক্তির শিকার হয়ে পড়েছেন। বলা বাহুল্য, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কুপ্রভাবে অনৈক্যের প্রবাহে ভেসে চলেছে সবাই। এসব কুপ্রভাবের প্রতিরোধ এবং কোরআনিক বিপ্লবের মহান লক্ষ্যে ১৮৬৬ ঈঃ সনে উত্তর ভারতের দেওবন্দে দারুল উলূম মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং আজো উক্ত প্রতিষ্ঠান তার অবদান অব্যাহত রেখে চলেছে। শুরু হতে দারুল উলুম দেওবন্দ মুসলিম উম্মাহর সার্বিক কল্যাণে বহুবিধ বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা চালিয়ে আসছে। বিশেষ করে শিক্ষাকে মৌল কর্মসূচী হিসেবে স্থান দিয়ে উহার প্রচার, প্রসার ও উন্নয়নকল্পে বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে বেফাক অর্থাৎ ঐক্য প্রতিষ্ঠা অন্যতম । দারুল উলূমকে ঐক্যের প্রতীক ও মারকায হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র উপমহাদেশে মাদরাসা শিক্ষার জাল বিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর এ মাদরাসাগুলোকে দারুল উলূম দেওবন্দের সঙ্গে প্রোথিত করে রাখা হয়েছিল।


দারুল উলূম দেওবন্দের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ৫ম নম্বরে বলা হয়েছে-“মাদারিস কায়েম করনা আওর দারুল উলূম ছে উনকা ইলহাক”। অর্থাৎ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা এবং দারুল উলূমের সঙ্গে এসবের ইলহাক করা। দারুল উলুমের অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাসমূহই দরসে নেজামী মাদরাসা, কওমী মাদরাসা, দেওবন্দী ধারার মাদরাসা প্রভৃতি নামে পরিচিত। ১৯৪৭ ঈসাব্দ সনের পর এতদাঞ্চলের মাদরাসাগুলো দারুল উলূম দেওবন্দ কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অপর দিকে তাৎক্ষণিকভাবে এতদুদ্দেশ্যে কোন কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠায় এ মাদরাসাগুলোর মধ্যে কোন ঐক্য, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠতে পারেনি। পরিণতিতে মাদরাসাগুলোর মধ্যে বিভেদ এবং তার ফলে আলেম সমাজের মধ্যে বিভেদ ব্যাপক আকার ধারণ করতে শুরু করে। অতঃপর এ বিভেদ জনজীবনেও প্রবেশ করে মুসলিম সমাজকেও শতধা বিভক্ত করে ফেলতে শুরু করে। এ মর্মান্তিক ও দুঃখজনক অবস্থার প্রেক্ষিতে কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় সর্বাগ্রে এ কওমী মাদরাসাগুলোকে কোন একটা কেন্দ্রীয় সংস্থার আওতায় এনে ঐক্যবদ্ধ করা এবং পরস্পরের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলা । যাতে আলেম সমাজের মধ্যেও সংহতি গড়ে ওঠে এবং এর সুফল সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । বস্তুতঃ এটা দারুল উলূম দেওবন্দের বৈপ্লবিক চিন্তাধারারই অন্যতম অংশ। অতএব, দারুল উলূমই ছিল মূলতঃ এ আদর্শের আলোকে একটা বেফাক ও ঐক্যসংস্থা অথবা আধুনিক পরিভাষায় একটা বোর্ড ও জাতীয় সংস্থা ।


বাংলাদেশের মাদরাসাগুলোর দুঃখজনক অবস্থার অবসানকল্পে দারুল উলূম দেওবন্দের অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশস্থ দারুল উলূমের শাখা-প্রশাখা প্রতিষ্ঠানসমূহকে একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে জাতির বৃহত্তম কল্যাণ কামনায় বাংলাদেশের সর্ব স্তরের মাশাইখ ও উলামায়ে কিরাম একটা কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড গড়ে তোলেন । এর নাম রাখা হয়- “বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ” সংক্ষেপে বেফাক। প্রকৃতপক্ষে আসমানী শিক্ষা ও এ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে জাতি গঠন, নিরক্ষরতা ও মূর্খতা দূরীকরণ এবং দরিদ্রতা ও সন্ত্রাসমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গঠন করার কোরআনিক বিধান বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই এ পদক্ষেপ।


আল্লহ পাক বলেন- তোমরা আল্লাহ ও তদীয় রসূলগণের নির্দেশ মেনে চলবে এবং পরস্পরে ঝগড়া-বিবাদ করবে না। কেননা, পরস্পর ঝগড়া বিবাদ করলে তোমাদের ঐক্য বিনষ্ট হবে এবং তোমরা হীনবল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব- প্রতিপত্তি শেষ হয়ে যাবে”। সূরা আনফাল : ৪৬। বিশ্বনবী (স.) ইরশাদ করেছেন- “ইলম অর্জন করা সকল মুসলমানের ওপর ফরয”।


তিনি আরো বলেন- “তোমরা ইলম অর্জন কর ও তা মানুষকে শিক্ষা দাও’’ । “তোমরা কোরআন শিখ ও তা মানুষকে শিক্ষা দাও’’। জ্ঞানের কথা একটি বাক্য হলেও তা আমার পক্ষ হতে অন্যের নিকট পৌঁছে দাও। তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সে, যে কোরআনের জ্ঞান অর্জন করে ও তা অন্যকে শিক্ষা দেয়।


কোরআনিক বিপ্লবের এ আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যেমন আত্মপ্রকাশ করেছিল দারুল উলুম দেওবন্দ, ঠিক তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আত্ম-প্রকাশ করেছে বাংলাদেশস্থ বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।